রাজশাহীতে বুধবার (২৮ এপ্রিল) থেকে কেজি দরে তরমুজ বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে। খুচরা কিংবা পাইকারি বাজারে কেজি দরে তরমুজ বিক্রি করলেই বিক্রেতাদের পড়তে হবে শাস্তির মুখে। মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) শালবাগান, ভদ্রা, তালাইমারী, বিনোদপুরসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার তরমুজের আড়তগুলো পরিদর্শনে গিয়ে এমনটিই জানিয়ে এসেছেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিজিত সরকার ও কৌশিক আহমেদ।
তাদের সঙ্গে জেলা বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেনও ছিলেন। অভিযান টের পেয়ে আড়ত বন্ধ করে পালিয়ে যান অধিকাংশ আড়ৎদার।
যারা ছিলেন তাদের সঙ্গে তরমুজের দাম নিয়ে কথা বলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ওই সময় জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়, বুধবার (২৮ এপ্রিল) থেকে কেজি নয়, তরমুজ বিক্রি করতে হবে পিস হিসেবেই। যাতে ক্রেতারা দাম করার সুযোগ পান। ফলে দাম কমে আসবে।
কিন্তু তাতে আপত্তি জানান অধিকাংশ আড়ৎদার। তাদের ভাষ্য, ‘কেজি দরে তরমুজ বিক্রি করলেই দাম কমবে, এমনটি সঠিক নয়। কেজি দরে বিক্রি করলেই বরং ধীরে ধীরে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।’ তবে জেলা প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
এদিকে, দুই সপ্তাহ ধরেই রাজশাহীর বাজারে তরমুজের দাম বেশ চড়া। ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে তরমুজ। মূলত রাজশাহী ও এর আশপাশে তরমুজ উৎপাদন কম হওয়ায় তরমুজ আসছে বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনাসহ দক্ষিনাঞ্চল থেকে। ফলে তরমজের স্থানীয় বাজার পাইকারি বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে।
কয়েকজন খুচরা তরমুজ বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, রাজশাহীর আড়ৎদারদের সিন্ডিকেট তরমুজের দাম বাড়িয়েছে। তরমুজের চাহিদা প্রচুর। চালান আসার পরপরই বিক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। এই সুযোগে দাম বাড়াচ্ছেন আড়ৎদাররা।
তারা জানিয়েছেন, প্রতি মণ তরমুজ তারা আড়ত থেকে ২ হাজার টাকায় কেনেন। এরসঙ্গে যোগ হয় গাড়িভাড়া ও শ্রমিকের খরচা। তারা বিক্রি করেন ২ হাজার ৪০০ টাকায়। কেজিপ্রতি দাম পড়ে ৬০ টাকা। একটি বড় সাইজের তরমুজের দাম অন্তত ৬০০ টাকা। যা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার একেবারেই বাইরে।
এদিকে, তরমুজের বাজার নজরদারিতে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক হাসান আল মারুফ মঙ্গলবার নগরীর বিভিন্ন এলাকার তরমুজের দোকান ঘুরে দেখেন।
এ সময় নগরীর সাহেববাজার এলাকার সাহাবুল ফল ভান্ডারে বাড়তি দামে তরমুজ বিক্রির প্রমাণ পায় ভোক্তা অধিকার। এছাড়া পণ্যের মূল্য তালিকাও টানাননি বিক্রেতা। এই অভিযোগে বিক্রেতাকে ২ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
নগরীর শালবাগান এলাকার তরমুজের আড়তেও অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার। এ সময় সেখানকার রাজশাহী ফল ভান্ডারেও মেলেনি পণ্য তালিকা। এই প্রতিষ্ঠানটিকেও ২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হাসান-আল-মারুফ বলেন, নির্ধারণ না থাকায় বাড়তি দামে তরমুজ বিক্রির বিষয়টি প্রমাণ করার সুযোগ নেই। তবুও তারা বাজারে নজরদারি চালাচ্ছেন। মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের সর্তক করে এসেছি। পরে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।
তিনি আরও বলেন, মূলত স্থানীয় ফলের আড়ৎদাররা কমিশনে ব্যবসা করেন। বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারীরা তাদের কাছে তরমুজ বিক্রি করেন। খুরচা বিক্রেতারা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে তরমুজ কেনেন। কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা লাভ রেখে তরমুজ বিক্রি করেন খুচরা বিক্রেতারা।
শালবাগান এলাকার মামা-ভাগ্নে ফল ভান্ডারের মালিক শাহিন হোসেন কালু জানান, তাদের কাছে খুলনা, বরগুনা এবং চুয়াডাঙ্গা থেকে এখন তরমুজ আসছে। ব্যাপারীদের কাছ থেকে আসা সেই তরমুজ মণ হিসেবে তারা খুরচা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। পিস হিসেবে তরমুজ বিক্রি করলে বাজার নিয়ন্ত্রণ আসবে, সেটি সঠিক নয়।
৪ বছর ধরে তরমুজের আবাদ নেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে। রাজশাহীতেও একেবারেই তলানিতে। মূলত নাটোর-নওগাঁয় তরমুজের চাষ হয় বেশি। ২০১৪-২০১৫ মৌসুমে রাজশাহীতে ৬৪০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়। তা থেকে উৎপাদন হয় ২২ হাজার ৩৭৮ টন।
সেবার সব চেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয় নাটোরে ৫৩২ হেক্টর জমিতে। ৩৮ দশমিক ১ টন হারে উৎপাদন হয় ২০২৬৫ টন। তরমুজ চাষ হয়নি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। বাকি দুই জেলার মধ্যে রাজশাহীতে ৩০ এবং নওগাঁয় ৭৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়।
পরের বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো তরমুজ চাষশূন্যে নেমে আসে রাজশাহীতেও। ওই মৌসুমে নওগাঁয় ৬০ হেক্টরে ২ হাজার ১০ টন এবং নাটোরে ৫২৭ হেক্টরে ১৯ হাজার ৯৬৩ টন তরমুজ উৎপাদন হয়।
২০১৬-১৭ মৌসুমে রাজশাহীতে ফেরে তরমুজের চাষ। সেবার জেলায় ১৫ দশমিক ৪ হেক্টর জমিতে তরমুজ উৎপাদন হয় ৬১৬ টন। এছাড়া নওগাঁয় ৬৪ হেক্টরে ২ হাজার ১০ এবং নাটোরে ৫২৭ হেক্টরে ১৯ হাজার ৯৬৩ টন তরমুজ ফলে।
২০১৭-১৮ মৌসুমে রাজশাহীতে ১৫ দশমিক ৪ হেক্টর জমিতে তরমুজ উৎপাদন হয় ৬১৬ টন। এছাড়া নওগাঁয় ৬৪ হেক্টরে ২ হাজার ১০ এবং নাটোরে ৪৯৪ হেক্টরে ১৯ হাজার ২৩০ টন তরমুজ উৎপাদন হয়।
এরপর ২০১৮-১৯ মৌসুমে রাজশাহীতে ১৫ দশমিক ৪ হেক্টর জমিতে ৬১৬ টন। নওগাঁয় ৬৪ হেক্টরে ২ হাজার ১০ টন এবং নাটোরে ৪৯৪ হেক্টরে ১৯ হাজার ২৩০ টন তরমুজ উৎপাদন ছিল।
সর্বশেষ ২০১৯-২০ মৌসুমে রাজশাহীতে ২২ দশমিক ৪ হেক্টর জমিতে তরমুজ উৎপাদন হয় ৭৯৭ দশমিক ৫ টন। এছাড়া নওগাঁয় ৩১ হেক্টরে ৬২০ টন এবং নাটোরে ৫৮২ হেক্টরে ২২ হাজার ৮১ টন তরমুজ উৎপাদন হয়।